অপরাধ

ঝিনাইদহে তিন জনকে হত্যা ও 'চরমপন্থি দলের দায় স্বীকার' নিয়ে ধোঁয়াশা

হত্যার ঘটনাটি ঘটেছে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর মাঠের শ্মশানঘাট এলাকায়।

স্থানীয় সাংবাদিক ও পুলিশের সাথে কথা বলে জানা যায়, শুক্রবার রাত আটটার দিকে শ্মশানঘাট এলাকায় গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান স্থানীয়রা। পরে খবর পেয়ে রাত ১২টার দিকে শ্মশানঘাট এলাকার একটি খালের পাশ থেকে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের প্রত্যেকের মাথায়ই গুলির চিহ্ন রয়েছে।

এর পরপরই গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে একটি বার্তা আসে যেখানে বলা হয়, ‘জাসদ গণবাহিনী’ নামে একটি সংগঠনের সদস্যদের হাতে এই তিন জন নিহত হয়েছেন।

অতীতে এই নামে একটি সংগঠনের অস্তিত্ব থাকলেও এখন এর সক্রিয়তা আছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

হত্যার ঘটনায় শনিবার রাত পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। শনিবার দুপুরে এই তথ্য জানিয়েছেন শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুম খান।

স্থানীয়রা বলছেন, সীমান্তবর্তী এই জেলা ও আশপাশের এলাকায় একসময় একাধিক চরমপন্থি দলের দৌরাত্ম্য ছিল। হত্যা-অপহরণের খবর প্রায়ই আসতো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সহিংসতার ঘটনা খুব একটা চোখে পড়েনি। এই ঘটনায় আবার স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক দানা বেঁধে উঠেছে।

পুলিশ তিনজনের লাশ খুঁজে পাওয়ার আগে গুলির শব্দ শুনতে পান স্থানীয়রা

নিহতদের পরিচয়

যে তিনজন নিহত হয়েছেন তারা হলেন–– হানিফ আলী, লিটন হোসেন ও রাইসুল ইসলাম।

এই তিনজনের মধ্যে হানিফ আলীর বিষয়ে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, পঞ্চাশোর্ধ এই ব্যক্তি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা ছিলেন।

বাকি দুইজন সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন কিনা–– তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে এটুকু জানা গেছে যে নিহত হানিফ আলীর সঙ্গে তাদের বেশ সখ্য ছিল। লিটন হোসেন ছিলেন হানিফ আলীর শ্যালক। তিনি হানিফ আলীর সাথেই ঘুরে বেড়াতেন।

আর রাইসুল ইসলাম স্নাতকোত্তর শেষ করে এলাকাতেই থাকতেন। তার বাড়ি পার্শ্ববর্তী জেলা কুষ্টিয়ায়।

ঝিনাইদহের স্থানীয় সাংবাদিক বিমল সাহা বিবিসিকে জানিয়েছেন, “নিহত হানিফের নামে অনেক মামলা ছিল। সেইসাথে, হানিফ আওয়ামী লীগের সাথেও জড়িত ছিলেন…মৎস্যজীবী লীগ।”

শৈলকুপা থানার ওসি মাসুম খান বিবিসিকে জানান, “হানিফ পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত। এই হানিফের নামে ১৭টি মামলা আছে, তার মাঝে নয়টিই হলো হত্যা মামলা।”

হত্যাকাণ্ডের শিকার “বাকি দুইজন হানিফের সহযোগী” বলেও উল্লেখ করেন মি. খান।

তিনি আরও বলেন, “বিগত সময়ে বিভিন্ন দল ওকে হায়ার করতো। প্রয়োজন হলে ওকে ‘মাসল পাওয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করতো…। গত ১৫ বছরে তো আওয়ামী লীগই ছিল, তারাই করছে।”

এদিকে শুক্রবার রাতেই এই তিনজনকে হত্যার ‘দায় স্বীকার করে’ হোয়াটসঅ্যাপে সাংবাদিকদের কাছে একটি ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। বার্তায় ‘জাসদ গণবাহিনী’ ও ‘কালু’ এই নামগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।

সেখানে লেখা ছিল— “ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনাবাসীর উদ্দেশে জানানো যাচ্ছে, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর শীর্ষ নেতা অসংখ্য খুন, গুম, দখলদারী, ডাকাতি, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হরিণাকুন্ডুনিবাসী হানিফ তার দুই সহযোগীসহ জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন।”

সেখানে হুঁশিয়ারি দিয়ে আরও বলা হয়, “এই অঞ্চলের হানিফের সহযোগীদের শুধরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো, অন্যথায় আপনাদের একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।”

শৈলকুপা থানার ওসি মি. খান কালুর পরিচয়ের বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কালু ইতিপূর্বে বিভিন্ন হত্যা করছে, তার নামে বিভিন্ন অভিযোগ আছে। সে আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোক। সে এখন পলাতক, প্রকাশ্যে দেখা যায় না তাকে।”

“ওর এক ভাই ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছিল। আরেক ভাই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ছিল,” যোগ করেন তিনি।

কালুর বাড়ি কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে বলেও তিনি জানান।

একজনের মরদেহ ধান খেতের পানির মধ্যে পাওয়া গেছে

কী কারণে খুন

একাধিক স্থানীয় সাংবাদিক, পুলিশ, মানবাধিকারকর্মীর সঙ্গে কথা হয়েছে । তাদের সবারই ধারণা, চরমপন্থি দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে।

এ বিষয়ে শৈলকুপা থানার ওসি মাসুম খানের ভাষ্য, “দলের মাঝেই দ্বন্দ্ব ছিল, এখন পর্যন্ত এটাই সামনে এসেছে। তারপরও এটা তদন্তাধীন। তদন্ত হয়ে গেলে আমরা বলতে পারবো।”

স্থানীয় সাংবাদিক বিমল সাহা এলাকার বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, “হানিফের নামে বোধহয় নতুন করে কোনো সংগঠন হচ্ছিলো, সেটিকে প্রতিরোধ করার জন্য হতে পারে। পূর্ব শত্রুতাও পারে।”

আরেক সাংবাদিক নয়ন খন্দকার আবার বলেন, “চরমপন্থি দলের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। তবে অনেকদিন এই ধরনের সহিংসতা ছিল না। দীর্ঘদিন পর আবার এরকম হত্যাকাণ্ড ঘটলো।”

ওই জেলার এক মানবাধিকারকর্মী আমিনুর রহমানের সাথেও এ বিষয়ে কথা হয়।

তিনি বলেন, “হঠাৎ করে গতকাল এটা ঘটেছে। এখানে অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকতে পারে।”

“বিগত অনেক বছর ধরে অনেকে কারাগারে ছিল। সরকার পতনের পর যারা বেরিয়েছে… তাদের হয়তো শত্রুতা ছিল। এগুলো সেই শত্রুতার প্রতিশোধ নেওয়াও হতে পারে।”

শৈলকুপা থানার ওসি এ বিষয়ে খুব সংক্ষেপে বলেন, “কিছু কিছু নাম আসছে…দলীয় কোন্দলে যারা আছে… এদের অনেকেই জামিন পেয়ে গেছে।”

গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, নিহতদের প্রত্যেককে শুক্রবার রাতে ফোন করে বাড়ি থেকে ডাকা হয়েছিলো। তবে কারা ডেকেছিলো, কী বলে ডেকেছিলো– সে বিষয়ে এখনও কোনো তথ্য জানা যায়নি।

ঝিনাইদহ জেলা বিএনপি’র সভাপতি এম এ মজিদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, তার মতে এই ঘটনা “চরমপন্থিদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতা এবং এটি আগে থেকেই আছে”।

তবে তিনি মনে করেন, “পুলিশ-প্রশাসনের নজরদারির দুর্বলতার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button