ফুটবল

নারীদের ফুটবল : পতন, নাকি নতুন উদ্যমে অগ্রগমন?

গত অক্টোবরে যে মেয়েরা সাফের ট্রফি জিতে ছাদখোলা বাসে সংবর্ধনা পেয়েছেন, তারা এখন অপমানে কাঁদছেন, হতাশা আর ক্ষোভে ভাবছেন ফুটবল ছেড়ে দেয়ার কথাও!

তারা এখন সাইবার বুলিংয়ের শিকার। কোচের বিরুদ্ধে নারী ফুটবলারদের বিদ্রোহের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দুই ভাগে বিভক্ত।এক পক্ষ নারী ফুটবলারদের প্রতি এতটাই আক্রমণাত্মক যে এমনকি অনবরত ধর্ষণ ও হত্যার হুমকিও আসছে৷ ফেসবুক পোস্টে এমন অভিযোগের কথা খুব স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন জাপানি বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি ফুটবলার মাতসুশিমা সুমাইয়া।

যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে

‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’ – সত্যজিৎ রায়ের অমর এক সৃষ্টির কথা বাংলাদেশে নারীদের ফুটবল প্রসঙ্গেও কারো কারো মনে পড়তেই পারে, কারণ, কোচ বাটলারের সঙ্গে ফুটবলারদের দ্বন্দ্ব প্রথম প্রকাশ্যে এসেছিল কাঠমান্ডুতেই৷২৮ জানুয়ারি জাতীয় দলের ক্যাম্পে থাকা ৩১ ফুটবলারের মধ্যে ১৮ ফুটবলার ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ইংল্যান্ড থেকে ছুটি কাটিয়ে ফেরার পরদিন টিম মিটিং ডাকেন বাটলার। কিন্তু ওই মিটিংয়ে উপস্থিত হননি ১৮ ফুটবলারের কেউ। এরপর থেকে অনুশীলন বর্জন করেন ফুটবলাররা।

ওয়েস্টহ্যাম ইউনাইটেডের সাবেক মিডফিল্ডার বাটলার এর আগে বতসোয়ানা ও লাইবেরিয়ার পুরুষদের জাতীয় ফুটবল দলের কোচ ছিলেন। ২০২৩ সালের নভেম্বরে দায়িত্ব নেন বাফুফের এলিট একাডেমির। এই কোচের অধীনে গত বছর অক্টোবরে নেপালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। অথচ অভিজ্ঞ এই কোচের কাছে অনুশীলন করবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন ফুটবলাররা। মাঠে ও মাঠের বাইরে দুর্ব্যবহারসহ কোচের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে তিন পৃষ্ঠার একটি চিঠি এরই মধ্যে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি তাবিথ আউয়াল বরাবর পাঠিয়েছেন মেয়েরা। বাটলারকে বাদ না দিলে গণ অবসরে যাবেন- এমন হুমকিও দিয়েছেন তারা। ৩০ জানুয়ারি গণমাধ্যমের সামনে এসব নিয়ে কথা বলেন অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। কথা বলার এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায় তাকে।

 

সাবিনাদের ক্ষোভের নেপথ্যে…

নারী ‍ফুটবলাররা দীর্ঘদিন ধরে নানা বঞ্চনার শিকার। ঘরোয়া নারী ফুটবল লিগের কাঠামো ঠিক নেই। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের আশা দেখিয়েও সেটার আয়োজন করতে পারেনি বাফুফের সাবেক সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের কমিটি। বিদেশি লিগে খেলার প্রস্তাব পেলেও নারী ফুটবলাররা অনুমতি পান না বেশিরভাগ সময়। চোটে পড়লে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। বরং চোটগ্রস্থ ফুটবলাররা একটা সময় ক্যাম্প ছাড়তে বাধ্য হন। ক্ষোভে, অভিমানে ফুটবল ছেড়েছেন সিরাত জাহান স্বপ্না, আঁখি খাতুন, আনাই মগিনি, আনুচিং মগিনি, সাজেদা আক্তারসহ অনেকে।

গত বছর আগস্টে প্রথমবার অনুষ্ঠিত হয় এএফসি ওমেন্স চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। এএফসির এ নতুন টুর্নামেন্টে বিভিন্ন দেশের ২২টি ক্লাব অংশ নেয়। কিন্তু বাংলাদেশের মাথায় দক্ষিণ এশীয় মহিলা ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট থাকলেও কোনো ক্লাবকে খেলতে যেতে দেওয়া হয়নি এএফসি ওমেন্স চ্যাম্পিয়নস লিগে। অথচ এএফসি একেকটি দলকে ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা (১ লাখ ইউএস ডলার) দিয়েছে শুধুমাত্র টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের জন্যই।

ওই সময় বাংলাদেশের নারীদের লিগের চ্যাম্পিয়ন ক্লাব বসুন্ধরা কিংস অংশ নিতে পারেনি ওমেন্স চ্যাম্পিয়নস লিগে। বাফুফে ‘রহস্যময়’ কারণে তাদের নাম এএফসিতে পাঠায়নি। কিন্তু বসুন্ধরা কিংসে তখন খেলতেন জাতীয় দলের সব ফুটবলার। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলতে না পারার কষ্ট মেয়েদের এখনো পোড়ায়।

এরপর জোড়া সাফ জিতেও ভাগ্য ফেরেনি নারী ফুটবল দলের। মেয়েদের সাফল্যে খুশি হয়ে অনেকে অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, সেনাবাহিনী, বিভিন্ন ব্যাংক ও স্পন্সর প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পুরস্কার বুঝিয়েও দিয়েছে। কিন্তু বাফুফের প্রতিশ্রুত দেড় কোটি টাকা বোনাসের ঘোষণাটা এখনো দেখেনি আলোর মুখ। শুধু বোনাসের অর্থ নয়, শেষ আটটি আন্তর্জাতিক ম্যাচের ম্যাচ ফি-ও জোটেনি নারী ফুটবলারদের কপালে। এর পাশাপাশি গত অক্টোবরে কেন্দ্রীয় চুক্তি শেষ হওয়ার পর নতুন চুক্তি হয়নি। যে কারণে নভেম্বর মাস থেকে মিলছে না সাবিনাদের বেতন। সব মিলিয়ে অনেক অপ্রাপ্তির বেদনা নিয়েই মেয়েরা ফুটবল ক্যাম্পে আছেন। কোচের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলা যায় সেই আগুনের ফুলকি মাত্র!

বাটলারের অধীনে অনুশীলন করতে চান না ফুটবলাররা- সেটা নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। সাবিনাদের চাওয়া ছিল, বাটলারের চুক্তি বাড়ানোর আগে অন্তত বাফুফে বিষয়টা নিয়ে তাদের সঙ্গে যেন আলোচনা করে। কিন্তু নারী ফুটবলারদের চুক্তি হয়নি, কোচের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ দুই বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে।

‘ব্রিটিশ কোচ কিন্তু পারফর্ম্যান্সের কারণে কাউকে বাদ দেননি’

সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের অধীনে দীর্ঘদিন অনুশীলন করেছেন মেয়েরা। ফলে ফুটবলারদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবেই গড়ে ওঠে ছোটনের। গড়ে ওঠে স্নেহ, ভালোবাসার সম্পর্ক। কিন্তু বিদেশি কোচ মেয়েদের খুব বেশি চেনেন না। ফলে শুধু মাঠের পারফরম্যান্স দিয়েই মূল্যায়ন করতে চান সবাইকে। তাছাড়া বাটলারের চোখে জুনিয়ররাই যেন সব, তারাই বাংলাদেশের নতুন ভবিষ্যৎ।

মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তারদের ফুটবল ক্যারিয়ারের প্রথম কোচ মফিজ উদ্দিন মনে করেন সিনিয়র-জুনিয়রের লড়াই এভাবে সামনে এনে নারীদের দলটাকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছেন বাটলার, “আমি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু জেনেছি, কোচ চাইছেন তিনি দীর্ঘমেয়াদে একটা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালাবেন। এবং এটা করতে গেলে উনি জুনিয়রদের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল বেশি থাকবেন স্বাভাবিক। সিনিয়রদের বয়স হয়ে গেছে। কিছুদিন পর তাদের পারফর্ম্যান্সের ঘাটতি হবে। উনি ভবিষ্যতের চিন্তা করে জুনিয়রদের বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের বর্তমানকে নিয়ে ভাবা উচিত আগে।”

মফিজ উদ্দিন আরো মনে করেন, পারফর্ম্যান্সের কারণে নয়, ব্যক্তিগত ঈর্ষা, অহমের জায়গা থেকেই ব্রিটিশ কোচ কোনো কোনো ফুটবলারকে একাদশে রাখেন না, “উনি কিন্তু পারফর্ম্যান্সের কারণে বাদ দেননি কাউকে। যেমন নেপালে মাসুরার সঙ্গে টুপি পরা নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব হয়েছে কোচের। মাসুরা জানতো না যে টুপি পরে খাবার টেবিলে যাওয়া ইংলিশ রীতিতে অন্যায়। কোচ এটা নিয়ে ওখানে মাসুরার সঙ্গে রাগারাগি না করলেও পারতেন।” মাসুরাও দাবি করেন, সাফের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে একাদশে তাকে না রাখার ওটাই বড় কারণ।

তবে টুপি পরা ইস্যুতে কোচকে অভিযুক্ত করাটা যুক্তিসঙ্গত মনে করেন না জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ডালিয়া আক্তার, “আমার কাছে মনে হয়েছে ইস্যুটা খুব একটা বড় না। বড় করা হয়েছে। কোচ বলেছে টুপি পরা যাবে না, মনের মধ্যে বিষয়টা লাগিয়ে ফেলেছে। এটা প্রেস মিটে বলাও যুক্তিসঙ্গত না। আমাদের সময়ে সমস্যা দেখা দিলে কোচের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছি।”

বাফুফের দায় কতটা?

কোচের সঙ্গে ফুটবলারদের দ্বন্দ্বের শুরু গত অক্টোবরে৷ সেটা মিটিয়ে ফেলা যেতো নেপাল থেকে নারীদের দল দেশে ফেরার পরেই। বাফুফে সভাপতিকে লেখা চিঠিতে ফুটবলাররাও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তারা লিখেছেন, “খেলোয়াড়দের সঙ্গে নেপালে ঘটে যাওয়া এত এত ঘটনার পরও কোচ পারতেন বিষয়টি সেখানেই সমাধান করতে। সাফ জিতে আসার পরপরই তিনি পারতেন আমাদের সঙ্গে বসতে। বরং সেটা না করে আমাদের উপেক্ষা করেছেন প্রতিনিয়ত।”

বিষয়টি এই পর্যায়ে টেনে আনার জন্য বাফুফেকেই দায়ী করলেন সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক মাসুদ আলম, ” অবস্থাটা এই পর্যায়ে কেন এলো? কেন এত দূর গড়ালো ঘটনাটা? বাটলারের বিরুদ্ধে মেয়েদের অনেক অভিযোগ, ওজর-আপত্তি ছিল, সেটা আগে থেকেই। তিনি যখন দায়িত্ব নেন, তখন থেকেই সমস্যার শুরু৷ সাবিনাকে প্রথম ম্যাচেই বাদ দেন একাদশ থেকে। এরপর অনেকগুলো ম্যাচ খেলেছে। কাঠমান্ডুতে গিয়েও আমরা সেই বিস্ফোরণ দেখেছি। অনেকে বলেছিল তার সঙ্গে অনুশীলন করতে চায় না। তারপরও বাফুফেকে জোর করে কেন এই কোচকেই আনতে হবে?”

তিনি যোগ করেন, “এটা এক-দুজন ফুটবলারের সমস্যা না। ১৮ জনের সমস্যা- বাংলাদেশের নারী ফুটবলে সাফল্য আনার পেছনে যাদের বড় অবদান। ঋতুপর্ণা সাফের সেরা ফুটবলার। তিনি কেন বলছেন কোচের বিরুদ্ধে? এর মানে, কোচের কোনো-না-কোনো সমস্যা আছে। সে ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি কেন এতদূর গড়াতে দিলো, এ জন্য বাফুফের জবাবদিহি করা উচিত। এবং যারা মেয়েদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button