বাংলাদেশে বায়ুদূষণ : নীরবে কাড়ে কত শত প্রাণ!

প্রতিদিন ঢাকার কর্মজীবী মানুষ রাজপথে নামেন কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে৷ পথে নেমেই পড়েন যানজট, ধুলা, ধোঁয়ার কবলে৷ধোঁয়া আর ধুলায় দূষিত এ বায়ু যে কত সাংঘাতিক ‘স্লো পয়জন’ তা কি জানেন সবাই?
প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর তালিকায় শীর্ষে আসে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নাম!
শুধু রাজধানী নয়, রাজধানীর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতেও যানবাহন, ইটভাটা ও কলকারখানার কারণে হচ্ছে বায়ুদূষণ৷ বাংলাদেশে অক্টোবর থেকে মার্চের শুষ্ক মৌসুমে বায়ুদূষণের মাত্রা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়৷ ঢাকায় তখন পরিস্থিতি হয়ে ওঠে ভয়াবহ৷
গত বছর ঢাকায় প্রতি মাসে বায়ুর মান ‘ভালো’ ছিল গড়ে মাত্র ১.৪ দিন, অর্থাৎ সারা বছরে প্রায় ১৭ দিন৷ ফলে ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দুই দেশের বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত দুই শহর দিল্লি ও লাহোরের চেয়ে খুব ভালো নয়৷
বায়ু দূষণের মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ২০১৬ সালের মার্চ মাস থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১০৭ মাসের তথ্য প্রতিদিন প্রকাশ করেছে৷ ২০২৪ সালে শুধু ঢাকাতেই ৬ দিন ছিল ‘চরম ঝুঁকিপূর্ণ’, ৯৩ দিন ছিল ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’, ৭০ দিন ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’, ১৩৩ দিন ছিল ‘সতর্কতামূলক’ এবং ৪৯ দিন ছিল ‘মাঝারি মানের’ বায়ু৷ তাদের হিসেব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মাত্র ১১ দিন ঢাকায় বাতাসের মান ‘ভালো’ ছিল৷ বছরের বাকি ৪ দিনের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি৷
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমান গবেষণা প্রতিষ্ঠান বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশে বায়ু দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৫ শতাংশ৷ মানুষ এত দিন ধরে এই দূষিত বায়ুতে নিঃশ্বাস নিয়েছে যে, বায়ুদূষণ এখন জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা একটি স্বাভাবিক ঘটনা৷”
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি দূষণের মাত্রা পাওয়া যায় বড় নির্মাণ প্রকল্পের এলাকাগুলো এবং যানজটপ্রবণ সড়কগুলোর কাছে, এর পরেই রয়েছে ইটভাটার এলাকাগুলো৷ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ূমান) জিয়াউল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, বাংলাদেশে ৩০% বায়ুদূষণ হয় উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে আসা বাতাসের মাধ্যমে এবং ৭০% দেশের অভ্যন্তরীন কারণে৷ বায়ুদূষণের জন্য মূলত দায়ী ইটভাটা ১৩%, নির্মাণাধীন অবকাঠামো থেকে আসা ধূলিকণা ১১%, বর্জ্য পোড়ানো ১১%, রান্নার প্রয়োজনে গৃহস্থালী বায়ুদূষণ ২৮%, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের দূষণ ২৪% এবং বাকিটা যানবাহন খাত থেকে৷
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-র তথ্য মতে, বিআরটিএতে নিবন্ধিত মোট ৬২ লাখ যানবাহনের মধ্যে ১ থেকে ১০ বছরের মধ্যে নিবন্ধিত সড়ক পরিবহণের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ, ৩০ শতাংশ ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ও ৩০ শতাংশ সড়ক পরিবহণ ২০ বছরের পুরনো৷ এছাড়া গত ২-৩ বছর প্রায় প্রতি বছরই প্রায় চার লাখ নতুন গাড়ির নিবন্ধন হয়৷

বিআরটিএএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শিতাংশু শেখর বিশ্বাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বায়ুদূষণে যানবাহন খাতের অবদান প্রায় ১১% এবং তা কমাতে এ বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে বিআরটিএর অনুমোদিত ২০ বছরের পুরনো যানবাহনগুলো আর পথে চলতে দেয়া হবে না৷এবং ফিটনেসবিহীন ডানবাহন চিহ্ণিত করতে রাজধানীর বাইরে অন্যান্য জেলাতে নতুন ১০টি স্বনিয়ন্ত্রিত যানবাহন পরীক্ষাকেন্দ্র চালু হবে৷ এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০% যানবাহন দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হবে৷ বিদ্যুৎচালিত যানবাহন কেনায় অনুপ্রাণিত করতে সরকারিভাবে বিভিন্ন প্রণোদনা ও চার্জিং পয়েন্টের ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে৷”
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান) জিয়াউল হক বলেন, ‘‘প্রতি বছর শহরাঞ্চলে প্রায় ১-২ শতাংশ হারে বাড়ছে বায়ুদূষণ৷ শুধু ঢাকাতেই সূক্ষ্ম বস্তুকণা বা পার্টিকুলেট ম্যাটার (PM2.5)-এর পরিমাণ দেশের বার্ষিক জাতীয় মানদণ্ড ৩৫ মাইক্রোগ্রামের তুলনার প্রায় তিন গুণের কাছাকাছি, অর্থাৎ ৮০-৮৫ মিলিগ্রাম৷ তবে, ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা এটা কমিয়ে ৫৫ মিলিগ্রামে নিয়ে আসার টার্গেট নিয়েছি – ২০ বছরের পুরনো যানবাহনগুলোকে আর চলতে দেয়া হবে না ৷ এছাড়াও, ট্রান্স-বাউন্ডরি দূষণ কমাতে গত দুই বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিয়মিত বৈঠক করছে৷”
বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি এনভায়রনমেন্টাল অ্যানালাইসিস অনুযায়ী, বাংলাদেশে পরিবেশজনিত স্বাস্থ্যঝুকির মাত্রা অত্যন্ত খারাপ পর্যায়ে রয়েছে, যার কারণে দেশের মোট অকালমৃত্যুর ৫৫% পরিবেশগত স্বাস্থ্যঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত৷ বাতাসে থাকা সবচেয়ে ক্ষতিকর দূষক হলো সূক্ষ্ম বস্তুকণা বা পার্টিকুলেট ম্যাটার (PM2.5) ৷ এই বস্তুকণার আকার এতটাই ক্ষুদ্র যে, এটি সহজেই ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করতে পারে এবং রক্তপ্রবাহে মিশে যেতে পারে, ফলে হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সারসহ বাঁড়িয়ে তোলে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকি৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান ৫টি কারণের মধ্যে দ্বিতীয়৷ এবং বাংলাদেশেই মৃত্যুর শীর্ষ ১০টি কারণের মধ্যে ৪টি সরাসরি বায়ু দূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত: স্ট্রোক, নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ ও ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ৷
জাতীয় বক্ষব্যাধি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইডিসিএইচ)-এর পরিচালক ডা. মো. সায়েদুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘প্রতিবছর হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে৷ স্বল্প জনবল নিয়ে অনেক রোগীকেই হাসপাতালে রেখে চিকিৎসাসেবা দেয়া যাচ্ছে না৷ শহরাঞ্চলে যানজটে আটকে থাকা গাড়িগুলো থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং নির্মাণাধীন অবকাঠামো থেকে বায়ুমন্ডলীয় ধূলিকণার কারণে বাড়ছে শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা৷ তার মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধের পাশাপাশি লক্ষণীয়ভাবে বাড়ছে তরুণ রোগীর সংখ্যা৷ যেহেতু তারা কাজের প্রয়োজনে দিনের একটা বড় অংশ বাড়ির বাইরে থাকছে, অর্থাৎ যানযটে আটকে থাকছে এবং দূষিত বায়ুতে নিশ্বাস নিচ্ছে৷ লক্ষ করে দেখা গেছে, তরুণ রোগীদের মধ্যে অনেকেরই কর্মক্ষতা কমে যাচ্ছে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজের কারণে৷”
সম্প্রতি, সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (সিআরই) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যে্ সূক্ষ্মকণা বায়ুদূষণের প্রভাব’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বায়ুমান বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুর মানদণ্ড অর্জন করতে পারলে বাঁচানো সম্ভব হতো ৮১ হাজারের বেশি প্রাণ৷
বায়ুদূষণ নিয়ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ূমান) জিয়াউল হক আরো বলেন, ‘‘বায়ুদূষণ কমাতে গিয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন আমরা অন্য দিকে আবার দূষণ না বাড়িয়ে ফেলি! পরিবহণ খাতে দূষণ কমাতে যে বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহার করা হবে এবং সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে যদি তা পরিবেশের আরো ক্ষতি করে, তখন এর ফলাফল হবে জিরো-সাম অবস্থার মতন৷ তাই এই বিষয়ে আমাদের বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে এবং নবায়নযোগ্য জ্বলানি ব্যবহারের কথা ভাবতে হবে৷”