যে পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশন নেই

পাসপোর্ট নিতে আর পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগবে না। ন্যাশনাল আইডি কার্ড বা জন্ম নিবন্ধনের ভিত্তিতেই পাওয়া যাবে পাসপোর্ট। শক্তিশালী পাসপের্টের সূচকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট বিশ্বের ৯৩তম। নতুন নিয়মে অবস্থার উন্নতি হবে তো?
সরকার বলছে, এতে পুলিশি হয়রানি থাকবে না, আরো কম সময়ে পাসপোর্ট দেয়া যাবে।
কিন্তু কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, অনেকের কাছে একাধিক ন্যাশনাল আইডি আর্ড আছে। অবৈধভাবে ন্যাশনাল আইডি কার্ড তৈরি করে রোহঙ্গিাদের পাসপোর্ট নেয়ারও নজির আছে। এর ফলে কি তাহলে অপরাধীরা বা বাংলাদেশের নাগরিক নন এমন মানুষদের পাসপোর্ট পাওায়ার আশঙ্কাও বাড়বে না? এর জবাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল সমস্যা গোড়ায়। সেটা ঠিক না করে পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন চালু রেখে পুলিশি হয়রানি অব্যাহত রাখার সুযোগ করে দেয়ার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া পাসপোর্ট পেলেই তো দেশের বাইরে যাওয়ার নিশ্চয়তা মেলে না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ(টিআইবি) ২০১৭ সালে পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছিল। ওই বছরের ২১ আগস্ট ‘পাসপোর্ট সেবায় সুশাসন: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, নতুন পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতির কারণে সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার হতে হয়।
টিআইবির গবেষণায় আরো বলা হয়, নতুন পাসপোর্টের আবেদনকারীদের তিন চতুর্থাংশই পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় অনিয়ম ও হয়রানির শিকার হয়ে ঘুস বা নিয়মবহির্ভূত টাকা’ দিতে বাধ্য হন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজামান ডয়চে ভেলেকে বলেন,” আমরাই প্রথম পাসাপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশন তুলে দেয়ার কথা বলেছিলাম। ঔপনিবেশিক আমলে এই পুলিশ ভেরিফিকেশন করাই হয় ক্ষমতার অপব্যবহার এবং এর মাধ্যমে অনৈতিকভাবে অর্থ আদায়ের জন্য। পাসপোর্ট নাগরিকদের অধিকার। আর অপরাধী বা অন্য কোনো অভিযোগ থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অন্য আইনি পদ্ধতি আছে। ইমিগ্রেশন আছে।”
“পাসপোর্টের ভিত্তি হবে নাগরিকত্ব। জন্ম নিবন্ধন বা ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেখে পাসপোর্ট দেয়াই নিয়ম। উন্নত বিশ্বেও এভাবেই দেয়া হয়,” বলেন তিনি।তবে পুলিশের সাবেক উপ-মহাপরিদর্শক(ডিআইজি) মাজেদুল ইসলাম বলেন ভিন্ন কথা। তিনি পুলিশের বিশেষ শাখায়(এসবি) কাজ করেছেন। পাসাপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশন এসবিই করে থাকে। তিনি বলেন, ” আসলে ভোটার আইডি কার্ড পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে হয় না। আর জন্মনিবন্ধনও তাই। আমি মনে করি, নাগরিকদের কোনো এক ব্যবস্থায় পুলিশ ভেরিফিকেশন হওয়া দরকার। এই অবস্থায় যদি ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট দেয়া হয়, তাহলে অপরাধীরা এর অপব্যবহার করতে পারে। আবার রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নেয়ার নজির আছে। সেটা তাদের জন্য আরো সুযোগ করে দেবে। আদম ব্যবসায়ীরাও এর সুযোগ নিতে পারে।”
“আমার বিবেবচনায় পুলিশি হয়রানি বন্ধ এবং ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে বের হতে পারলে সমস্যার সমাধান হতো। এখন যেটা করা হচ্ছে, তাতে সমস্যা আরো বাড়তে পারে। বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হতে পারে,”বলেন তিনি।
গত বছরের ফেব্রয়ারি মাসে ঢাকা, কক্সবাজার ও টাঙ্গাইলে অভিযান চালিয়ে গোয়েন্দা বিভাগ ১৪৩ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্টসহ আটক করে। তারা ভুয়া কাগজপত্রে জাতীয় পরিচয় পত্র ও জন্ম সনদ তৈরি করে ওই পাসপোর্ট নিয়েছিল। তাদের পুলিশ ভেরিফিকেশনেও আটকানো যায়নি। এই কাজ করার জন্য পাসপোর্ট অফিসসহ বিভিন্ন পর্যায়ে একটি চক্র কাজ করে।
প্রতি বছরই এরকম ঘটনা ধরা পড়ে। মাজেদুল ইসলাম বলেন, ” আমার অভিজ্ঞতা বলছে, এভাবে গত কয়েক বছরে কয়েক হাজার রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট নিয়েছে। অপরাধীরাও নেয়। আমার কথা হলো সেই সুযোগ আরো অবারিত হবে পুলিশ ভেরিফিকেশন না থাকলে। বিশ্বের বিভিন্ন এয়ারপোর্টে আমাদের দেশের নাগরিকরা আরো ঝামেলায় পড়বে। ভিসা পেতেও সমস্যা হতে পারে।,” বলেন তিনি।
তিনি জানান, বাংলাদেশের নাগরিকদের সত্যিকার অর্থে কোনো কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ নাই। পুলিশের একটি ডাটাবেজ আছে, সেটা যেসব ব্যক্তি গ্রেপ্তার হন তাদের তথ্য দিয়ে করা হয়। তাও আবার নিয়মিত আপডেট করা হয়না। ন্যাশনাল আইডি হয় ভোটার লিষ্ট ধরে। এখানে যে তথ্য থাকে তা সাধারণ তথ্য। তার অপরাধ, মামলার তথ্য থাকে না। আপডেট হয় না। অনেক ভুল তথ্য থাকে। তার কথা, ” যদি জন্মের পর থেকেই নাগরিকের একটি ডাটাবেজ তৈরি হতো এবং তার নিয়মিত আপডেট হতো তাহলে পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগত না।”
প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ১২-১৩ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য দেশের বাইরে যায়। এখানে প্রতারণা হয়। আশঙ্কা আছে পার্সপোর্ট ভেরিফিকেশন ছাড়া হলে বিদেশ যাওয়ার এই প্রবণতা আরো বাড়বে। আরেক শ্রেণির জনশক্তি রপ্তানিকারক এর সুযোগ নিতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা)-র মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ” সেই সুযোগ কেউ নিতে পারেন। তবে পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন তুলে দেয়া আমাদের জন্য কোনো সমস্যা নয়। বরং এটা তুলে দিয়ে মানুষের হয়রানি কমবে।”
“পাসপোর্ট পাওয়া যে-কোনো নাগরিকের সিটিজেন রাইট। আর পাসপোর্ট পেলেই যে একজন বিদেশে যেতে পারবেন, তা নয়। নানা কারণে তার বিদেশে যাওয়া আটকে যেতে পারে। তার পাসপোর্ট প্রত্যাহার করা যায়, বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায়। ইমিগ্রেশন কাজ করে। সুতরাং কেউ বিদেশ ভ্রমণের উপযুক্ত না হলে তাকে আটকানোর অনেক পথ আছে,” বলেন তিনি।
তার কথা, “এনআইডি, জন্মনিবন্ধন, পাসপোর্ট সবখানেই তো নানা ধরনের অপকর্ম আর প্রতারণা আছে। পুলিশ ভেরিফিকেশন থাকার পরও তো রোহিঙ্গারা, অপরাধীরা পার্সপোর্ট নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। তাহলে এই ফেরিফিকেশন দিয়ে কী হবে? হয়রানি ছাড়া আর কিছুই হয় না। সাধারণ মানুষকে পুলিশ ভেরিফিকেশনে আটকে দেয়া হয়। কিন্তু অপরাধী, রোহিঙ্গারা ক্লিয়ারেন্স পেয়ে যায়।”
সরকারের পাসপোর্ট বিভাগের ওয়েবসাইট বলছে, পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশনে যে বিষয়গুলো যাচাই করা হয়, তা হলো- ১. আবেদনকারীর জাতীয়তা (অর্থাৎ বাংলাদেশের নাগরিক কিনা)২.স্থায়ী ও অস্থায়ী ঠিকানা ৩. কর্মসংস্থান ৪.পারিবারিক অবস্থা ৫. তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা আছে কিনা ইত্যাদি তথ্য এবং ৬.পূর্বে কোনো মামলা থেকে থাকলে সেই মামলা খারিজ হয়ে থাকলে সেই তথ্য।
এই তথ্যগুলো পুলিশের বিশেষ শাখা যাচাই করে সরেজমিন গিয়ে। তারা ওই তথ্য সংক্রান্ত কাগজপত্র দোখে। সবগুলো ঠিক থাকলে পাসাপোর্ট অফিস বায়োমেট্রিক ও ছবি তুলে পাসপোর্ট দেয়ার প্রক্রিয়া শেষ করে। এই কাজ করতে সর্বোচ্চ ১৫ দিন সময় বেধে দেয়া আছে। সাদা চোখে দেখলে এখনো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বাস্তবে অর্থ আদায়ের জন্য পুলিশ এখানে ঘাটে ঘাটে হয়রানি করে। পুলিশ আসলে টাকা ছাড়া পজিটিভ রিপোর্ট দেয় না। সব কিছু ঠিক থাকলেও অর্থ দিতে হয় বলে জানান মিরপুরের একজন ভুক্তভোগী জেসমিন লিপি। তার কথা, ” পুলিশ বাসায় এসেছে, টাকা দিতেই হবে। কম আর বেশি। আর টাকা দিলে সব রিপোর্টই পজিটিভ হয়ে যায়।”
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ” পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানিা তো একটি বিষয়। কিন্তু আবেদন থেকে শুরু করে পাসপোর্ট হাতে পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে হয়রানির ফাঁদ পাতা। টাকা না দিলে হয় না। তাই পুরো সমস্যার সমাধান করতে হলে এর সংস্কার এবং পাসপোর্টকে পুরোপুরি ডিজিটালাইজেশন করতে হবে।”
ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন,” আসলে এনআইডির ভিত্তিতেই পাসপোর্ট দেয়া উচিত। এটাই নিয়ম। পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট হয়রানি ছাড়া আর কিছুই নয়। এনআইডি ও জন্ম নিবন্ধন সঠিকভাবে দিলেই আর সমস্যা থাকবে না। কিন্তু এখানে তো জাস্টিন ট্রুডোর জন্ম নিবন্ধনও করা গেছে।”
বাংলাদেশে সর্বশেষ ই-পাসপোর্ট চালু হয়েছে। এর পাশাপাশি মেশিন রিডেবল পাসপোর্টও আছে। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত তিন কোটি ৪১ লাখ ১০ হাজার ৩৭১টি মেশিন রিডেবল(এমআরপি) পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়েছে। আর ই পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়েছে দুই কোটির বেশি। হাতে লেখা পাসপোর্ট আর এখন দেয়া হয় না। প্রতিদিন ২৫ হাজার পাসপোর্ট প্রিন্ট করতে সক্ষম পাসপোর্ট অধিদপ্তর। দেশের প্রতিটি জেলায় পাসপোর্ট অফিস আছে। এছাড়া বিশ্বের ৭৩টি বাংলাদেশি মিশনে এমআরপি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
বিশ্বের শক্তিশালী পাসপের্টের সূচকে বাংলাদেশের পাসপোর্টের অবস্থান এখন ৯৩তম। বাংলাদেশের সঙ্গে একই অবস্থানে আছে লিবিয়া ও ফিলিস্তিন। ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স এই সূচক তৈরি করে। তবে এই সূচক তৈরি করা হয় একটি দেশের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায়। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ” আমাদের দেশের নাগরিকরা পাসপোর্টের অপব্যবহার বেশি করেন। ফলে সূচকে আমরা পিছিয়ে। সুশাসন, মানব পাচার, মানবাধিকার, মানব উন্নয়ন সূচক, জাল পাসাপোর্ট এই বিষয়গুলো তারা বিবেচনায় নেয়।” “এর সঙ্গে পুলিশ ভেরিফিকেশেনের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই,” বলেন তিনি।
তবে যদি এনআইডি সিস্টেম যথার্থ না করা হয়, তাহলে পুলিশ ভেরিফিকেশন তুলে দিলে আশঙ্কা থেকেই যাবে বলে মনে করেন পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মো. মাসুদ রেজওয়ান। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পাওয়ার আশঙ্কা আছে। তিনি বলেন, ” ১২ লাখ রোহিঙ্গা আছে। ২০১৭ সালের পর আমি যখন মহাপরিচালক ছিলাম, তখন রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা হিসাবে পরিচয়পত্র দিতে তাদের আঙ্গুলের ছাপ নিয়েছিলাম। সেগুলো এখন সংরক্ষণ করা আছে কিনা জানি না। সেগুলো যদি পাসপোর্টের সার্ভারে যুক্ত করা থাকে, তাহলে রোহিঙ্গারা পাসাপোর্ট করাতে আসলেই ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু সেটা করা হয়ে না থাকলে এই সুযোগে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পাওয়ার সুযোগ তৈরি করবে। সেই সুযোগ তারা নেয়ার চেষ্টা করবে।”
তিনি বলেন, ” রোহিঙ্গারা তো সবই জাল করতে পারে। এনআইডি তারা জাল করে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে করে। এর সঙ্গে এনআইডি তৈরির একটি গ্রুপসহ বিশাল চক্র জড়িত। তারপরও তাদের বড় একটি অংশ পুলিশ ভেরিফিকেশনে ধরা পড়তো। ফলে এখন এনআইডির ক্ষেত্রে জালিয়াতি থাকলে তাদের আর ধরা যাবে না।”
